
সু্প্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের পরে আজ, বুধবার রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় পুরোদমে পড়াশোনা চালু হওয়ার কথা। গত ৩ এপ্রিল শীর্ষ আদালত এসএসসি মামলার রায় ঘোষণা করেছে।
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নির্দেশে তার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ফার্স্ট সামেটিভ পরীক্ষা, চলেছে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত। ফলে আপাতত ক্লাস হচ্ছিল না। সোম, মঙ্গলবার— এই দু’দিনই ছিল ছুটি। এতদিন তথাকথিত ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারা কেউ স্কুলে আসছিলেন, কেউ আসছিলেন না। তাতে রেগুলার ক্লাসের সমস্যা ততটা বোঝা যাচ্ছিল না।
তবে আজ পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস চালু হওয়ার কথা। আবার উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের নির্দেশে একাদশের ফাইনাল পরীক্ষায় বসা ছাত্রছাত্রীদেরও আজ থেকে দ্বাদশের প্রথম সেমেস্টারের ক্লাস শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে চাকরিহারা তথাকথিত ‘যোগ্য’ শিক্ষকরা রবিবারই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সম্মান না ফিরলে’ এখন আর স্কুলে যাবেন না তাঁরা। ইতিমধ্যে ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের একটি দল আজ, বুধবার দিল্লির যন্তরমন্তরে অবস্থান–ধর্নায় সামিল হচ্ছেন।
অনেকে কলকাতায় ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে বসে রয়েছেন। কেউ কেউ আবার শীর্ষ আদালতের কথা মাথায় রেখে নতুন করে নিয়োগ পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি হচ্ছেন। আর বিকল্প হিসেবে যে আংশিক সময়ের বাড়তি শিক্ষক নেওয়া যাবে, অনেক স্কুলের তহবিলে এত টাকাও নেই। তা হলে আজ থেকে ক্লাস নেবেন কারা— এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
পরিস্থিতি আঁচ করে রীতিমতো দিশেহারা দশ হাজার ছুঁই ছুঁই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও টিচার ইনচার্জরা। কারণ, স্কুলে স্কুলে পর্ষদের বিধি মেনে শিক্ষকদের এখন সোম থেকে শনিবার পর্যন্ত এক একজন শিক্ষককে ২৫টি থিওরি ও ১১টি টিউটোরিয়াল ক্লাস নিতে হয়। তার মধ্যে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস রয়েছে। ফলে কোনও স্কুলে একজন শিক্ষক–শিক্ষিকার চাকরি গেলেই সেই ক্ষতি তিনি কাদের দিয়ে পূরণ করবেন— এটাই সবচেয়ে বড় চিন্তার।
এই পরিস্থিতিতে এক একটি স্কুলের প্রধানরা এক এক রকম পন্থা নিয়েছেন। কেউ একাদশ–দ্বাদশের ক্লাস সামলাতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অনুমতি নিচ্ছেন আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য। কেউ আবার টাকা না–থাকায় প্যারাটিচারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কোনও স্কুল আবার চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের উপরেই ভরসা রাখতে চাইছেন, যাতে ওই শিক্ষকরা আপাতত ক্লাস চালিয়ে দেন। কিন্তু তাঁরা যদি ‘অনুরোধ’ না–রাখেন, তা হলে কী হবে কেউ জানে না। কোনও স্কুল আবার সদ্য অবসর নেওয়া শিক্ষক–শিক্ষিকাদেরই সাময়িক ভাবে স্কুলে এসে ক্লাস নেওয়ার কথা বলেছে। কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা আবার মাধ্যমিক স্তরের পঠনপাঠনের জন্য প্রাক্তনীদের উপরেও নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।
যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষর তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দেশিকা আসেনি। তাই আমরা প্রবল সংশয়ে। এই সঙ্কটের সময়ে বিকল্প বলতে একমাত্র আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষেই তা করতে হবে।’ তার জন্যও স্কুলের ফান্ড দরকার। কলকাতা বা শহরতলির স্কুলগুলির তহবিলে কিছু ক্ষেত্রে সেই টাকা থাকলেও গ্রাম ও মফসসলের বহু স্কুলের তহবিলেই আবার টাকা নেই। ফলে তারা আরও বিপাকে পড়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের রাধাকান্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনজন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। ফলে বাংলা ও বায়োলজি বিভাগে শিক্ষক শূন্য।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই সামেটিভ পরীক্ষার খাতা দেখছেন বিদ্যালয়ে আসা বিএড প্রশিক্ষণরতরাই। প্রধান শিক্ষক শিশির বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের স্কুলের তহবিলে টাকা নেই। পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বিএড প্রশিক্ষণরত স্যর ও ম্যাডামরাই মানবিকতার খাতিরে কিছু খাতা দেখে দিচ্ছেন।’
হুগলির খানাকুলের ঠাকুররানিচকের শঙ্কর বাসেদ আলি ইনস্টিটিউশনে ৮০০ জন পড়ুয়া। ১৪ জন শিক্ষকের মধ্যে পাঁচজনের চাকরি গিয়েছে। পরীক্ষা সামাল দিতে আংশিক সময়ের শিক্ষকদের ইনভিজিলেটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক শিবশঙ্কর সামন্ত জানান, চাকরিহারা শিক্ষকদেরই ফোন করে সামেটিভ পরীক্ষার খাতা দেখার অনুরোধ করা হয়েছে। তাঁরা কেউ কেউ রাজি। অবসরপ্রাপ্ত পার্শ্বশিক্ষকদেরও সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আরামবাগের ডিহিবাগনান কেবি রায় উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাবে ২০১৮ সালেই বাণিজ্য শাখা বন্ধ করতে হয়েছিল। সুপ্রিম–রায়ে উচ্চ মাধ্যমিকে রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা এবং অঙ্কের শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে ইতিহাসের দু’জন, অঙ্ক এবং ইংরেজির একজন করে শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্লাস চালাতে প্রাক্তনীদের শরণাপন্ন হয়েছেন।
হাওড়ার পাঁচলার আজিম মোয়াজ্জিম হাইস্কুলের চারজন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। এই অবস্থায় স্কুল কর্তৃপক্ষ চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকদেরই খাতা দেখার অনুরোধ করবেন বলে জানা গিয়েছে। নদিয়ার দীঘলগ্রাম নেতাজি বিদ্যাপীঠে তিনজন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। তার মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষকও আছেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক শান্তনু মণ্ডল বলেন, ‘ওঁরা ফিরে না এলে হয় বিষয়গুলো পড়ানো বন্ধ করতে হবে, তা না হলে সংসদের নির্দেশে আপাতত ক্লাস্টার করে চালাতে হবে।’ উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের বীরগ্রাম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের কথায়, ‘বিজ্ঞানের কোনও শিক্ষকই নেই স্কুলে। পরীক্ষার খাতা দেখার বাড়তি দায়িত্ব পার্শ্বশিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দিয়েই ক্লাস নিতে হবে আপাতত।’ বীরভূমের সাঁইথিয়া হাইস্কুলে চারজন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেমিস্ট্রিরই দু’জন। প্রধান শিক্ষক জগবন্ধু রায়ের বক্তব্য, ‘স্কুলেরই অন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব দিতে হবে। কারণ, আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্কুলের টাকা নেই।’