October 13, 2025
18

গোয়ালপাড়া, অসম, ১০ জুলাই: ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত সাতভান্ডি, তকিমারি ও তারিয়ারবিতা গ্রামের বাসিন্দারা আজও বেঁচে আছেন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে—যে কোনো মুহূর্তে একটি বন্যা তাঁদের ঘর, জমি ও জীবনের সমস্ত অর্জন কেড়ে নিতে পারে। বর্ষাকালে নদীর জলস্ফীতি ও তীব্র ভাঙনের ফলে এই অঞ্চলের মানুষ বারবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, অথচ প্রশাসনিক পদক্ষেপ রয়ে গেছে সীমিত ও বিলম্বিত।

স্থানীয় এক কৃষক বলেন, “আমার ঘর, জমি—সবই চলে গেছে। এখন প্রতিবেশীদের দয়ায় বেঁচে আছি। বিধায়ক এসে কিছু জিও-ব্যাগ দিয়েছিলেন, কিন্তু নদী তো জিও-ব্যাগ চেনে না।” নদীর তীব্র ভাঙনে ৫০০ জিও-ব্যাগও টিকতে পারেনি, বরং নদী এখন গ্রামগুলোকেই গ্রাস করছে।

মাজুলির সংকট ও ভাঙনের ভয়াবহতা

বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলিতেও পরিস্থিতি ভয়াবহ। শতাব্দীপ্রাচীন সত্ৰ ও উর্বর কৃষিজমি আজ ব্রহ্মপুত্রের রোষে বিপন্ন। ভাকত চাপরি অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যার পর ১৬টি গ্রাম চরম ভাঙনের মুখে। বহু পরিবার প্রতিদিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কীভাবে তাঁদের অতীত ও ভবিষ্যৎ নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের ₹৫০০ কোটি ব্যয়ে নির্মিত পাকুপাইন বাঁধও নদীর রোষে ধ্বংস হয়েছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়িয়েছে। এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা কৃষিকাজে নির্ভরশীল। নদী যদি জমি খেয়ে নেয়, তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচব?”

বারবার বাস্তুচ্যুতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা

২০০৪ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সরকার মাজুলির সালমারা থেকে বাস্তুচ্যুত ৫৩টি পরিবারকে জোরহাটের ঢেকিয়াখোয়া অঞ্চলে পুনর্বাসন দিয়েছিল। ‘দা গাসুক ইন্দিরা আদর্শ গাঁও’ নামে পরিচিত এই পুনর্বাসন গ্রামে প্রতিটি পরিবারকে আধা বিঘা জমি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পুনর্বাসনও স্থায়ী হয়নি—কারণ নদীর ভাঙন থেমে থাকেনি।

প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

জুন মাসে চাবুয়ার বালিজান পরিদর্শনে গিয়ে জলসম্পদ মন্ত্রী পীযুষ হাজরিকা জানান, “আমরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছি। পর্কুপাইন স্ট্রাকচার বসানো হয়েছে, এবং বর্ষা শেষে স্থায়ী ভাঙন প্রতিরোধমূলক কাজ শুরু হবে।” তিনি আরও বলেন, “বড় জিও-ব্যাগ দিয়ে বাঁধ শক্তিশালী করা হবে।”

তবে স্থানীয়দের মতে, এই প্রতিশ্রুতি বহুবার শোনা গেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তাঁরা চান, মন্ত্রী নিজে এসে ধ্বংসস্তূপ দেখুন, মানুষের কান্না শুনুন।

একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দাবি

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীর তলদেশ খনন, আধুনিক জিও-মেটেরিয়াল দিয়ে বাঁধ নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামগুলিকে স্থানান্তর—এই তিনটি পদক্ষেপ ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ছাড়া এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব।

এক প্রবীণ কৃষক বলেন, “ব্রহ্মপুত্র আমাদের জীবনরেখা, কিন্তু এখন সে-ই আমাদের অভিশাপ। সরকার যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আমরা সব হারিয়ে ফেলব। কতবার আমরা শূন্য থেকে জীবন শুরু করব?”

এই প্রশ্নই আজ গোয়ালপাড়া থেকে মাজুলি পর্যন্ত প্রতিটি নদীতীরবর্তী মানুষের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *